প্রত্যয় ডেস্ক : এবার আমের দেশে কমলায় বাজিমাত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলে মাল্টা, পেয়ারা, ড্রাগন ফ্রুটের পর এবার বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে কমলার চাষ। সফলতাও পেয়েছেন কৃষকরা। উৎপাদন খরচ কম এবং স্বাদ ও ঘ্রাণে অতুলনীয় বহু কৃষক হওয়ায় স্বপ্ন দেখছেন বাণিজ্যিকভাবে কমলা চাষের। পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এই ফলের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণেও। এছাড়া আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণ অনুকূলে থাকায় কমলা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনার কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ ফলের উঁকি যে কারও দৃষ্টি কাড়ে নিঃসন্দেহে। যার দেখা মেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষক মতিউর রহমানের কমলা বাগানে। বরেন্দ্রর লাল রুক্ষ মাটিতে কমলার চাষ কয়েকবছর আগেও এ অঞ্চলের কৃষকদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। তবে সেই বৃত্ত ভেঙে বিদেশি জাতের এ কমলালেবুর চাষ হচ্ছে এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্রভূমিতে। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষক মতিউর রহমান।
তার বাগানের প্রতিটি গাছে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচা-পাকা কমলা। মাল্টার পর এবার কমলা ফলিয়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন এই কৃষক। বরেন্দ্র ভূমিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় তার হাত ধরেই এর আগে মাল্টার বিপ্লব ঘটে।
মাল্টার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে চার বছর আগে নিজের বাগানে ২০ প্রজাতির কমলা নিয়ে কাজ শুরু করেন বৃক্ষ রোপণে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এই ফল চাষি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নের জামতাড়া এলাকায় তার ১৬ বিঘার মিশ্র ফলের বাগান। তিনি সফলতা পান যুক্তরাষ্ট্রের মেন্ডারিন, চায়না, দার্জিলিং ও অস্ট্রেলিয়া এই চার জাতের কমলায়। বর্তমানে তার বাগানে গাছের সংখ্যা ৫৫০টি। এবার প্রতিটি গাছেই ফল ধরেছে আশাতীত। গাছ রোপণের দ্বিতীয় বছরেই ফল পেয়েছেন। তবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পান চার বছরের মাথায়।
সফল কমলা চাষি মতিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউন প্রতিনিধিকে জানান, ‘এবার প্রতিটি গাছে গড়ে ফলন পেয়েছি ৩০ থেকে ৪০ কেজি। বাগান থেকে প্রতি কেজি কমলা বিক্রি করছি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। গত বছর কমলা থেকে আয় হয়েছিল দুই লাখ টাকা। এবার পাঁচ লাখের আশা করছি। ইতোমধ্যে কমলার প্রায় ২০ হাজার চারাও বিক্রি করেছি। এ বছর টার্গেট ৫০ হাজার চারা তৈরির। এ চারা দিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠবে মাল্টার মতোই বাণিজ্যিক কমলার বাগান। আকারভেদে এসব চারার দাম ১০০ থেকে ২৫০ টাকা। আমার মতো নতুন উদ্যোক্তারাও বাণিজ্যিকভাবে কমলা চাষে মাল্টার মতোই লাভবান হবেন।’
এদিকে, তার সফলতা দেখে জেলায় এখন অনেকেই শুরু করেছেন বাণিজ্যিক কমলার চাষ। আর এ ফল চাষে সরকারি সহায়তা চান বরেন্দ্র অঞ্চলের ফল বাগানিরা। সফল ফল চাষি রফিকুল ইসলাম জানান, ‘আমি ৮৪০ বিঘার ফলের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। যেখানে পেয়ারা, মাল্টা, ড্রাগন, ১৮ জাতের আম, সফেদা, পার্সিমনসহ বিভিন্ন জাতের ফলের চাষ করছি। পাশাপাশি দেশি বিলুপ্তপ্রায় ফল নিয়েও আমরা গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছি। এবার আমার ফলের প্রজেক্টে নতুন সংযোজন করেছি কমলা চাষও। মতিউর ভাইয়ের সফলতায় আমি মুগ্ধ হয়ে তার কাছ থেকে কলম চারা সংগ্রহ করে ৭০ বিঘা জমিতে কমলার বাগান গড়ে তুলেছি। এখন আমার গাছের বয়স পাঁচ মাস। আশা করছি সামনের বছর আমিও ফল পাবো এবং সফল হবো।’
সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (গবেষণা) কমলা রঞ্জন দাসও এই কমলা বাগান পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের এই ভূমিতে উদ্যোক্তা হিসেবে মতিউর রহমান কমলা ফলিয়ে রীতিমত বিপ্লব ঘটিয়েছেন।’
স্থানীয় প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই পরিদর্শন করেছেন এই কমলা বাগান, তারা মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন মতিউরের কমলা চাষের সফলতায়। এই কমলা বাগান দেখতে বেড়েছে দর্শনার্থীর সংখ্যাও। প্রতিদিনই বাড়ছে বিভিন্ন স্থান থেকে দেখতে আসা দর্শনার্থী এবং উৎসাহী ও উদ্যোক্তা চাষির সংখ্যা।
সরেজমিন কথা হয় কমলার বাগান দেখতে আসা হাসিব হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কমলার টানে মতিউর ভাইয়ের বাগান দেখতে এসেছি। থোকায় থোকায় কমলা দেখে আমি অভিভূত। বাগান থেকে কমলা পেড়ে খেলাম। যা কখনোই ভাবিনি। এর স্বাদ ও মিষ্টতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সবমিলিয়ে আলাদা ধরনের এক অনুভূতি। আমি মনে করি এই ধরনের উদ্যোগগুলোকে সব পর্যায় থেকে সহায়তা করা উচিত। এতে যারা উদ্যোক্তা রয়েছে তারা অনুপ্রাণিত হবে। মতিউরের এই সাফল্য সত্যিই প্রশংসনীয়। এই উদ্যোগগুলো বেঁচে থাকুক এই প্রত্যাশা করছি।’
তবে এই ফল চাষের কিছু সমস্যাও রয়েছে। গাছে মাকড়ের আক্রমণ এবং ফল আসলে ফ্রুটফ্লাইয়ের উপদ্রব দেখা দেয়। যা দমনে বাড়তি সর্তকতার পাশাপাশি স্থায়ী সমাধানের জন্য দরকার ফল গবেষকদের কার্যকর গবেষণা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এমনটাই মনে করেই সফল কমলা চাষি মতিউর রহমান।
তবে মাকড় বড় ধরনের কোনও সমস্যা নয় উল্লেখ করে ফল গবেষকরা বলছেন, সেক্ষেত্রে এবামেকটিন গ্রুপের ইনসেক্টিসাইড শিডিউল স্প্রে করলে এটা দমন করা সম্ভব। ফ্রুটফ্লাইয়ের ক্ষেত্রে ফ্রুট ব্যাগিং, পাশাপাশি অন্যান্য যেসব প্রযুক্তি আছে বায়োলজিক্যাল, সেগুলো ব্যবহার করলে এবং সুন্দরভাবে ব্যবস্থাপনা করলে তেমন কোনও ক্ষতি হবে না। চাষিরা সজাগ থাকলে এবং সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলে চাষিরা ভালো প্রযুক্তি পাবে এবং উৎপাদনে কোনও ব্যাঘাত হবে না। তবে স্থায়ী সমাধানে এবং ফ্রুটফ্লাই দমনে আরও কার্যকর গবেষণার দরকার আছে বলেও মনে করেন ফল গবেষকরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের জার্মপ্লাজম অফিসার জহুরুল ইসলাম জানান, ‘এ অঞ্চলের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু কমলা চাষের জন্য উপযোগী। তাই মাল্টার মতো এই ফলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়েও আশাবাদী আমরা। এটি জেলায় ভালো হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে আমরা মতিউর রহমানের উৎপাদিত কমলা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। গত বছর আমাদের ল্যাবে বিদেশি আমদানিকৃত কমলা এবং এখানকার উৎপাদিত কমলা পরীক্ষা করেছি। সেখানে দেখা গেছে আমদানিকৃত কমলার চেয়ে এখানকার উৎপাদিত কমলা কোনও অংশেই কম নয়। খোসা পাতলা। সহজেই ছাড়ানো যায় এবং ভেতরের কোয়াও বেশ সুন্দর। এটি খেতে সুস্বাদু এবং মিষ্টতাও বেশ ভালো।’
এই ফল গবেষক আরও জানান, ‘দেশে নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সময়ে ভালো মানের দেশি ফলের প্রাপ্যতা অনেক কম; সেদিকে দৃষ্টি দিলে চাষিরা কমলা চাষ করলে বিদেশি এই ফলের আমদানি নির্ভরশীলতা অনেকটা কমে আসবে এবং বাণিজ্যিকভাবে কমলা চাষে লাভবান হবে।’ তবে ভালো বাগান গড়ে তুলতে মাতৃগাছের কলম চারা রোপণের পরামর্শ এই ফল গবেষকের।
আর কৃষি বিভাগ বলছে, এ ধরনের ফল উৎপাদনে সবসময় সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে কৃষি বিভাগ। সরকারিভাবে এই ফলের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে গ্রহণ করা হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনাও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম জানান, ‘আমরা আশা করি এখানকার কৃষকরা কমলা চাষের যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, তাতে আগামী দিনে এই বরেন্দ্র ভূমিতে মাল্টার মতো কমলাতেও আমরা সফল হবো। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহী ও উদ্যোক্তা চাষিদের আমরা টেকনিক্যাল সাপোর্ট, প্রশিক্ষণ, পাশাপাশি ভালো চারা পেতে সহায়তা করছি। শুধু তাই নয়, আমরা সরকারের প্রকল্পের মাধ্যমেও কমলা চাষ সম্প্রসারণে কাজ করছি প্রতিটি উপজেলায়। আমরা আশা করছি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাল্টার মতো কমলা চাষ সম্প্রসারণেও সফল হবো।’